লিখেছেন নাঈমুল করিম
ঢাকা, জুলাই ২ (থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন)- অনেক হতভাগা বাংলাদেশির মতো কোমল শোহলাগরও ভেবেছিলেন বিদেশে কোনো চাকরি পেলে তার জীবন পাল্টে যাবে। সত্যিই তা হয়েছে- কিন্তু তিনি যেভাবে আশা করেছিলেন, সেভাবে নয়।
৩৩ বছর বয়সী শোহলাগর মানবপাচারকারিদের সাথে ইউরোপ যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়া যান, সেখানে পাচারকারিরা তার পরিবারের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায়ের জন্য তাকে বন্দি করে।
তাকে মুক্ত করে আনতে ১৪ হাজার ডলার খরচ হয়, যা তার পরিবার ঋণ করে পরিশোধ করে। অবশেষে গত বছর দেশে ফিরে তিনি বেকার হয়ে যান এবং বিপুল পরিমাণ ঋণের চাপে আত্মঘাতী হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পড়েন।
“আমি সত্যিই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার পরিবার বিপুল অর্থ ঋণ নিয়েছিলো,” থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন শোহলাগর ।
“ঋণদাতারা প্রায় প্রতিদিনই বাড়িতে এসে আমাদের হুমকি দিয়ে যায়। এমন অবস্থাও হয়েছিলো যখন আমি ফাঁসিতে ঝুলে পড়ার কথাও ভেবেছি।”
বাংলাদেশে কাজ করা দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য মতে, এ রকম হাজারও অভিবাসী দেশে ফিরে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। কিন্তু তাদের জন্য সরকারি সহায়তা অপ্রতুল।
বাংলাদেশের বহু মানুষ পাচারের শিকার হন, কিন্তু দেশে তারা যে ধরনের বিপদে পড়েন তার প্রতিকারও খুবই সামান্য। বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার উপর নির্ভরশীল এবং নাগরিকদের বিদেশে চাকরি খোঁজার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার সরকারি নীতিও আছে।
সরকারি তথ্য মতে, ২০১৭ সালে অন্তত এক মিলিয়ন বাংলাদেশি বিদেশি চাকরি নিয়েছেন, যা এ যাবতকালের রেকর্ড।
কিন্তু বিদেশে চাকরি পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া লাইসেন্সবিহীন দালালদের উপর নির্ভরশীল, যা মানবপাচার ও প্রতারণার সুযোগ তৈরি করে।
গত মাসে ৬৪ জন ইউরোপগামী অভিবাসী বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়ায় নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এর আগে, গত মে মাসে একই অঞ্চলে ৩৭ জন নৌকাডুবিতে মারা যান।
“দেশে ফিরে আসা অভিবাসীদের সাহায্যের জন্য সরকারের যথাযথ কোনো প্রক্রিয়া নেই,” বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ব্রাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান।
“আমাদের নীতিমালা কেবলই লোকজনকে বিদেশে পাঠানোকেন্দ্রিক। অথচ প্রতি বছর কতোজন অভিবাসী দেশে ফেরত আসেন তা গনণা করার কোনো পদ্ধতিও আমাদের নেই।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাচারবিরোধী উদ্যোগের প্রধান সরকারি কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক এ কথা স্বীকার করেছেন যে, দেশে ফেরত আসা অভিবাসীদের সাহায্য করার জন্য সরকারকে নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে।
“ফেরত আসা অভিবাসীরা যাতে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারেন, আপাতত আমরা সেটাই নিশ্চিত করি। আমাদের যতোটা সামর্থ্য আছে, তাতে এটুকুই সম্ভবপর হয়।” তিনি বলেন।
তিনি আরো বলেন, “আমরা ভারতে পাচার হওয়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাও আমরা করতে পারি। কিন্তু কাউন্সেলিং এমন একটা বিষয়, যা আমরা কার্যকরভাবে করতে পারিনি। আমাদের কর্মপদ্ধতি আরো উন্নত করা প্রয়োজন।”
মিথ্যা আশ্বাস
কতোজন অভিবাসী প্রতারণার শিকার হন এ বিষয়ক কোনো সরকারি নথি নেই, তবে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে প্রতি বছর হাজার হাজার অভিবাসী বিদেশে প্রতারিত হন।
অভিবাসী অধিকার সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের এক জরিপে উঠে এসেছে যে, দেশে ফিরে আসা ৫১ শতাংশ অভিবাসী বিদেশে প্রতারণা ও অমানবিক আচরণের শিকার হন।
ওই জরিপ থেকে আরো জানা গেছে যে, যারা বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকা খরচ করেন তাদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন দেশের বাইরেই যেতে পারেন না।
শোহলাগরের মতো আরো ঘটনা এখন স্বাভাবিক।
অভিবাসীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর মতে, বহু অভিবাসীর ঋণ পরিশোধ করার জন্য আবার বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
“অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য ঋণদাতাদের লাগাতার চাপের কারণে বহু অভিবাসী দেশে ফেরার পর নিজ বাড়িতে থাকতে পারেন না।” আইওএম’এর অভিবাসন ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান প্রভিনা গুরুং এমন মন্তব্য করেন।
তিনি আরো বলেন, “আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনে অক্ষমতা, সামাজিক পুন:প্রতিষ্ঠা এবং মনোসামাজিক যন্ত্রণা প্রায়ই তাদেরকে পুনরায় অনিরাপদ অভিবাসন, আরো ঋণগ্রহণ, এমন কি আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করে।”
৪০ বছর বয়সী মোহাম্মদ জাকির হোসেন একটি তৈরি পোশাক কারখানায় টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন। আরো লাভজনক কাজের আশায় তিনি দালালদেরকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা দেন।
কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়া এবং পাচারকারীরা তাকে ইতালি নেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাদের সাথে কাজ করতে বাধ্য করে। এমনকি তার বেতনের কিছু অংশও কেটে নেওয়া হয়।
ঢাকায় ফিরে আসার পর থেকে তিনি পাঁচ হাজার ডলার ঋণ পরিশোধ করার আশায় ফুটপাথে একটি ফলের দোকান চালান। এই টাকা তিনি ইতালি যাওয়ার জন্য খরচ করেছিলেন। কিন্তু তিনি বলেন, সুযোগ পেলে আবার বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
“আপনি হয়তো আমাকে পাগল বলবেন, কিন্তু এটা সত্যি যে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেলে আমি আবার ঋণ করবো।”
তিনি আরো বলেন, “বৃদ্ধা মা’সহ পাঁচজন লোক আমার উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমি এখন যা আয় করি, তা কোনোভাবে যথেষ্ট নয়।”
দেশে ফেরা অভিবাসীদের সহায়তা করার স্থানীয় সংস্থা ব্র্যাক তিন-স্তর বিশিষ্ট উদ্যোগ অনুসরণ করে বলে জানিয়েছেন হাসান। ব্র্যাক অভিবাসীদের দেশে ফিরতে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয়, আর্থিক সহায়তা করে এবং কাউন্সেলিং করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল চৌধুরী দেশে ফেরা অভিবাসীদের কাউন্সেলিং করেছেন।
সরকারের কাছে দেশে ফেরত আসা অভিবাসীদের পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক অভিবাসী ধর্ষিত হন বা যৌন-নিগ্রহের শিকার হন।
তিনি বলেন, “অভিবাসী শ্রমিকরা স্বপ্ন ভাঙার দুঃখ নিয়ে দেশে ফেরেন।”
Our Standards: The Thomson Reuters Trust Principles.