ঢাকা, অক্টোবর ২৯ (থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন) — ভাগ্যের সন্ধ্যানে মধ্য প্রাচ্যে কাজ করতে গিয়ে অত্যাচার- নির্যাতনের শিকার হন বহু বাংলাদেশি নারী। এরপর মানসিকভাবে আহত হয়ে যখন দেশে ফেরেন তারা, তখন তাদের লড়াই করতে হয় ন্যায় বিচারের জন্য। কারণ দালালরা তাদের ভয়-ভীতি দেখায় এবং আইনী সহায়তার জন্য অর্থ খরচ করার সামর্থ্যও তাদের নেই। একটি মানবাধিকার সংস্থা বুধবার এমনই মন্তব্য করেছে।
সম্প্রতি অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকেইউপি) নামের স্থানীয় এক মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, তারা বিদেশ থেকে ফেরা ১১০ জন গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ কর্মী তাদের পুরো বেতন পাননি, ৬১ শতাংশ শারীরিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন, ২৪ শতাংশ ঠিক মতো খাবার পাননি এবং ১৪ শতাংশ যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন।
নুরি বেগম নামের একজন সম্প্রতি তার দালালের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আদালতে যান। এই নারী সৌদি আরবের এক পরিবারের গৃহকর্মী হিসেবে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই মাস কাজ করেও তিনি কোনো বেতন পাননি। উল্টো দুই মাস জেল খেটে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়।
থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে নুরি বেগম বলেন, “যে দালালের মাধ্যমে আমি সৌদি আরব গিয়েছিলাম, সে আমাকে প্রহার করে পা ভেঙে দিয়েছিলো কারণ তার বিরুদ্ধে আমি মামলা করেছি। তার মার খেয়ে আমি ১৫ দিন হাসপাতালে পড়ে ছিলাম। আমার বাড়ির পাশের এলাকার দালালের ভয়ে আমি এখন এক বান্ধবীর বাসায় থাকি।”
অভিবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ বিষয়ে বলেন যে, অভিবাসী কল্যাণ ও তাদের প্রতিপালনে সরকারের আরো বেশি অর্থ খরচ করা দরকার।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশের নারী কর্মীদের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমাদের এখন তাদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপরও কিছু সমস্যা আছে এবং এগুলো সমাধাণে আমাদের কাজ করতে হবে।”
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানবসম্পদ রপ্তানি করা দেশগুলোর অন্যতম। প্রতি বছর অন্তত সাত লাখ লোক বিদেশে চাকরির সন্ধান করেন। কিন্তু বিদেশে চাকরির বেশির ভাগ নিয়োগই দেওয়া হয় বেসরকারি দালালদের মাধ্যমে, যা মানবপাচার ও নির্যাতনের আশঙ্কা বৃদ্ধি করে।
ওকেউইপির মতে, প্রতি দশজন অভিবাসীর মধ্যে একজনই নারী এবং তাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষিত নন এবং দরিদ্র। তাদেরকে ২০ হাজার টাকা বেতনের মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হলেও তারা আসলে খুব বেতন পান। এ ছাড়া তাদেরকে কোনো চুক্তিপত্র দেওয়া হয় না, যদিও বৈধ কাজেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
গবেষণা মতে, প্রতি বছর হাজার হাজার অভিবাসী শূন্যহাতে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তাদের প্রতি হাজারে মাত্র ৩১৮ জন সরকারের মানবসম্পদ কর্মসংস্থান ও ট্রেনিং ব্যুরো থেকে গড়ে ৯.২০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পান।
সরকারি তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব সরকারের এক চুক্তির পর ২০১৭ সালে মোট ৮৩ হাজার নারী কর্মী মধ্য প্রাচ্যে কাজ করতে যান।
একই সাথে দেশে ফিরে আসা নারী কর্মীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় দাতা সংস্থা ব্রাকের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে ১,৩০০ ও এখন পর্যন্ত ২০১৯ সালে মোট ৯০০ নারী কর্মী মধ্য প্রাচ্য থেকে ফিরে এসেছেন এবং তাদের বেশির ভাগই অসাদাচরণ, নির্যাতন ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে আসা অনেক ওকেইউপি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মধ্য প্রাচ্যের নিয়োগদাতাদের তাদের প্রহার করতো, গলা টিপে ধরতো এবং না খাইয়ে রাখতো। শুধু তাই না, হেনস্থা করা মালিকের কাছে কাজ করতে বাধ্য করতো। অথচ এই নির্যাতিতদের দেশে ফেরার খরচও বহন করতে হয়েছে তাদেরই পরিবারকে।
ওকেইউপি জানিয়েছে, এতো কিছুর পরও নির্যাতিত নারীরা আদালতে যেতে চান না। তারা মনে করেন আইনপ্রক্রিয়া দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া তারা মনে করেন তাদের সাথে যা হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা মানে হলো সমাজে কলঙ্কিত হয়ে পড়া। এর পাশাপাশি নিয়োগকর্তা দালালদের মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি তো আছেই।
এর মধ্যেও কেউ কেউ ব্যতিক্রম, যেমন নুরি বেগম। তিনি যে কোনো উপায়েই আদালতের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে বধ্যপরিকর।
তিনি থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, “সে যেহেতু আমার গায়ে হাত তুলেছে, আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
(১ ডলার = ৮৪.৫০০০ টাকা) (প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন নাঈমুল করিম @Naimonthefield; সম্পাদনা করেছেন কেটি মিগিরো। অনুগ্রহ করে থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে ক্রেডিট দিন, যা থম্পসন রয়টার্সের দাতব্য শাখা এবং যা মানবিক, নারী ও এলজিবিটি+ অধিকার, মানবপাচার, সম্পত্তির অধিকার এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করে। ভিজিট করুন: http://news.trust.org)
Our Standards: The Thomson Reuters Trust Principles.