লিখেছেন রলি শ্রীবাস্তব ও নাঈমুল করিম
দক্ষিণ ২৪ পরগণা, ভারত/ ঢাকা, অক্টোবর ৯ (থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন) - মাত্র ১৫ বছর বয়সী প্রিয়াকে কণ্ঠশিল্পী বানানোর লোভ দেখিয়ে তার সাথে প্রতারণা করেন তারই এক আত্মীয়। এরপর তাকে অজ্ঞান করে বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পার করে ভারতের যৌন-ব্যবসায় পাচার করে দেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গের পূর্বাঞ্চলের এক যৌনপল্লীতে স্থান হয় প্রিয়ার। সেখান থেকে বেশ কয়েকবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ছয় বছর সেখানেই তাকে বন্দি থাকতে হয়। এরপর পুলিশ ও পাচারবিরোধী আন্দোলনকারিরা একদিন ভারত ও বাংলাদেশের অন্য কয়েকজন মেয়ের সাথে তাকেও উদ্ধার করে।
উদ্ধার হওয়ার পর প্রিয়া হয়তো বাড়িতে ফেরার এবং তার শিল্পী হওয়ার সাধনায় মন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উদ্ধার হওয়ার তিন বছর এসেও মনে হচ্ছে, তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াই এখন সবচেয়ে কঠিন এক কাজ।
প্রিয়ার বয়স এখন ২৪ বছর। যৌনদাসত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচা আরো অন্তত ১৮০ জন বাংলাদেশির সাথে তিনি পশ্চিমবঙ্গের এক আশ্রয়কেন্দ্রে আটকা পড়ে আছেন। দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তাদের দেশে ফেরার সরকারি বাঁধা কাটছেই না।
“আমি আর কতো অপেক্ষা করবো?”, বাংলাদেশে লোকলজ্জায় পড়ার ভয়ে নিজের আসল পরিচয় গোপন করে ছদ্মনাম ব্যবহার করে এমন মন্তব্য করেন প্রিয়া।
“এখন যদি তারা আমাকে যেতেও বলে আমি বোধহয় আর যাবো না,” গত মাসে আশ্রয়কেন্দ্রের কাগুজে গোলাপে সাজানো এক ঘরে বসে বলেন তিনি।
থম্পসন রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে যে, দেশে ফিরতে চাওয়া দুর্গতদের অন্তত ১৫টি ধাপে বাঁধার মুখে পড়তে হয়। এর মধ্যে আছে পুলিশ, সামাজিক কর্মী ও বিচারক ও দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।
সামাজিক কর্মীদের মতে, এক দিকে দুই দেশ থেকেই বলা হচ্ছে যে তারা দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন, অন্য দিকে দীর্ঘ অপেক্ষার ধকল আটকে থাকাদের নতুন জীবন শুরু করার ইচ্ছা নষ্ট করে দিচ্ছে এবং একই সাথে তাদেরকে আবারও পাচার হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে পাচারের শিকার হওয়াদের দেশে ফিরতে সহায়তাকারি প্রতিষ্ঠান জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের তারিকুল ইসলাম বলেন, “আশ্রয়কেন্দ্রের জীবন খুবই যন্ত্রণাময় হয়ে উঠতে পারে। কেউ যদি দুই বছর বা এর চেয়ে বেশি সময় পর ফেরেন, তাহলে তাদের জন্য পরিবর্তিত জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানো এবং মানসিক অবসাদ কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে যায়।”
তিনি আরো বলেন, “পাচারকারিরা তাদের শিকার হওয়াদের তালিকা সংরক্ষণ করে, এমন কি তারা দেশে ফেরার পরও। তারা যখন দেখে যে দেশে ফেরার পর দুর্গতদের কেউ চাকরি খুঁজছেন বা সবার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না, তখন আবার পাচারকারিরা তাকে লক্ষ্যবস্তু বানায়।”
দ্রুত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতে কাজ চলছে
প্রতি বছর কয়েক হাজার বাংলাদেশি ভারতে পাচারের শিকার হন এবং তাদের সিংহভাগকেই পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয় বা গৃহস্থালির কাজে নিয়োগ করা হয়। পাচারবিরোধীকর্মীরা এমন তথ্যই দিচ্ছেন, যদিও এ বিষয়ক সরকারি নথি অপ্রতুল।
গত আট বছরে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ পাচারের শিকার ১৭৫০ জনকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। যাদের বেশির ভাগই নারী ও তরুণী।
পাচারবিরোধী কর্মীরা বলছেন, এদের বেশির ভাগই আশ্রয়কেন্দ্রে আটকা পড়ে ছিলেন। প্রথমত আইনি কার্যক্রম এবং দ্বিতীয়ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কারণে তাদের ফিরতে দেরি হয়েছে।
এ বিষয়ক আইনি প্রক্রিয়া ধীরগতির এবং রায় হয় কদাচিৎ। ভারতে পাচারের মামলার প্রতি চারটির একটিতে রায় হয়। অন্য দিকে, বাংলাদেশে ২০১২ সালের এক আইনে মাত্র ৩০টি পাচারের মামলার রায় হয়েছে এবং চার হাজারের বেশি মামলা বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ।
পাচারের শিকার হওয়াদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে ভারত ও বাংলাদেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু পাচারের শিকার হওয়াদের সাথে কী ধরনের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে, তা ভারতের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে, সেখানকার পাচারবিরোধী কর্মীগণ এমনই মনে করেন।
দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চুক্তি শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সম্পাদক ফেরদৌসি আখতার বলেন, “বর্তমানে প্রত্যাবাসনের জন্য ১৮ থেকে ২২ মাস পর্যন্ত সময় লাগছে। ভারত থেকে প্রত্যাবাসিত হতে একজন দুর্গতকে অনেক পর্যায় পার হতে হয়। আমরা এই ধাপগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি, এতে দুর্গতরা কম সময়ের মধ্যে দেশে ফিরতে পারবেন।”
এ দিকে পাচারবিরোধী কর্মীরা বলছেন, একজন দুর্গতের জন্য এই পরিস্থিতি ছয় বছর পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে যেতে পারে।
নির্ঘুম রাত
দুই সন্তানের মা বসিরন থাকেন বাংলাদেশের রাজধানীঘেসা এলাকার এক ছোট বাড়িতে। সম্প্রতি তিনি স্মরণ করছিলেন সেই ফোন কলের কথা যখন তাকে জানানো হয় যে এক বছর আগে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের ভারতের এক পতিতাপল্লীতে খুঁজে পাওয়া গেছে।
৪৭ বছর বয়সী এই বিধবা নারী বলেন, “এই কথা শুনে আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার হৃদয় ফেটে যাবে।”
ওই কিশোরী মেয়েদের বয়স এখন ১৬ ও ১৭ বছর। তাদেরকে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের এক পতিতালয় থেকে উদ্ধার করা হয়। সেখানে তাদেরকে মাদক দিয়ে অচেতন করে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হতো।
এর মধ্যে দুই বছর হয়ে গেছে এবং এখনো তারা বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বসে আছেন।
তাদেরকে পাচার করার দায়ে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু এখনো তাদেরকে আদালতে পাঠানো হয়নি। যার ফলে নির্যাতনের শিকার কিশোরীরা দেশে ফেরার এবং সাক্ষ্য দেওয়ার অনুমতি পাচ্ছেন না।
পশ্চিমবঙ্গে পাচারের শিকার হওয়াদের এক আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা যায়, দুই বোন গাছগাছালিতে ভরা ও নদীঘেরা এক কুঁড়ে ঘরের ছবি এঁকেছেন; তাদের স্মৃতিতে এটাই তাদের বাড়ি।
এই দুই বোনের ছোটজনের নাম নীলা। কোনো দিন দেশে ফিরতে পারলে ঋণ নিয়ে একটি বিউটি পার্লার দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
নীলা বলেন, “আমাদের সাথে উদ্ধার হওয়া ভারতীয় মেয়েদের বাড়ি ফিরতে কোনো সময়ই লাগেনি। তাদের জন্য আমাদের ভালো লাগে। একদিন নিশ্চয়ই আমরাও বাড়ি ফিরবো।”
কথা বলার সময় ডান হাতে শরীরে ক্ষত ঢেকে রাখছিলেন নীলা। পতিতালয়ে থাকার সময় নিজেকে আঘাত করেছিলেন তিনি।
বসিরন এবং তার মেয়েরা প্রায়ই ফোনে কথা বলেন। তাদের আলাপে মামলা-মোকাদ্দমার কথা তেমন থাকে না। তারা কথা বলেন খাবার-দাবার এবং নতুন দেখা চলচ্চিত্র নিয়ে। এ দিকে তাদের মা তাদের ফিরে পাওয়ার আশা হারিয়ে ফেলছেন এবং ক্রমেই মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন।
গৃহস্থালির কাজ করা বসিরন বলেন, “মাঝে মাঝে খবরে দেখি যে শিশু বাচ্চাদের অপহরণ করা হয়েছে বা খুন করা হয়েছে, সে দিন রাতে আর ঘুমাতে পারি না।”
তিনি আরো বলেন, “কতো বছর হয়ে গেলো মেয়েদের দেখি না। এমন কি একটা ছবিও নয়। আমি জানি না ওরা এখন দেখতে কেমন।”
ঝুলে থাকা মামলা
পশ্চিমবঙ্গে উদ্ধার করা পাচারের শিকার লোকদের সর্বোচ্চ ২১ সপ্তাহের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠানোর বিধান আছে, কিন্তু তা হয় না বললেই চলে। রাজ্যের এক কর্মকর্তা বলেন, এ রকম হওয়ার কারণ হলো ভারতের দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া এবং দুর্গতরা তাদের নাগরিক কি না তা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানাতে বিলম্ব করা।
এ ছাড়া এর আরো কারণ হলো, প্রচুর পরিমাণে জমে থাকা মামলা। দুর্গতরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের পরিবার প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে এই ভাবনায় বাড়ির ঠিকানা প্রকাশ করেন না। আবার অনেক বছর দেখা না হওয়ার কারণে আত্মীয়রাও দুর্গতদের চিনতে পারেন না।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আনতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সাথে দুর্গতদের ছবি প্রদান করা শুরু করেছে। এতোদিন শুধু মাত্র নাম, লিঙ্গ ও বয়স প্রদান করা হতো।
সম্প্রতি রাজ্য সরকারের পাচারবিরোধী পরামর্শক মধুমিতা হালদার তার অফিসে কাজ করার সময় তার ফোনে তোলা বাংলাদেশি এক কিশোরীর ছবি দেখান। একটি ছবিতে দেখা যায় কিশোরীটি স্কার্ফ পরিহিত। অন্য ছবিতে তার মুখে কড়া প্রসাধনী দেখা যায়।
মধুমিতা বলেন, “এইটুকু দেখে কিভাবে বাবা-মা কাউকে চিনতে পারবে?” এ সময় মধুমিতার টেবিলে দেখা যায় প্রচুর মামলার কাগজপত্র জমে আছে।
মধুমিতা জানান, পাচারের শিকার হওয়ার পর উদ্ধার হওয়া ১৮০ নারীর মধ্যে ৮০ শতাংশের পরিচয় এখনো বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত করেনি। এদের মধ্যে অনেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষমান আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা বলেন পুলিশ কখনোই কারো পরিচয় নিশ্চিত করতে ছয় সপ্তাহের বেশি সময় নেয় না, যদিও কখনো কখনো দুর্গতদের ঠিকানা নিশ্চিত হতে আরো সময়ের দরকার পড়ে।
এর মধ্যে, তলপেটে তীব্র ব্যথাজনিত কারণে একজন কিশোরীর মৃত্যু হয়। পরে আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তারা চিহ্নিত করেন যে, মাদকের কারণেই এমনটি ঘটেছে। মৃত্যুর আগে ওই কিশোরী বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার অপেক্ষায় ছিলো, জানিয়েছেন পাচারবিরোধী কর্মী তপতী ভৌমিক।
পশ্চিমবঙ্গের পাচারবিরোধী দাতব্য সংস্থা সনলাপে কাজ করা ভৌমিক বলেন, “তার মৃত্যুর এক থেকে দেড় দিনের মধ্যেই তার প্রত্যাবাসনের সমস্ত কাজ সম্পন্ন করা হয়।”
“নিজের দেশে ফেরার জন্য কি এই মেয়েদের মরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই?” মন্তব্য করেন ভৌমিক।
এ দিকে, প্রিয়ার ঘটনাটা শেষ হয়েছে কিছুটা ভালোভাবে।
থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের সাথে কথা বলার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দেশে ফেরেন। তার আগে ভারতে তাকে কাটাতে হয় পাক্কা নয়টি বছর।
প্রিয়া বর্তমানে আরেকটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। একটি দাতব্য সংস্থা তার খোঁজ-খবর রাখছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি তার নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন।
“আমি জানি না আমার বাড়ি এখন দেখতে কেমন হয়েছে। তবে দেখলেই আমি চিনতে পারবো। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে ফিরতে পারছি ভেবে ভালো লাগছে।” আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফোনে এ কথা বলেন প্রিয়া।
তিনি আরো বলেন, “এখন আমি কেবল বাড়িতে ফিরতে এবং পরিবারের সাথে দেখা করতে উন্মুখ হয়ে আছি।”
(প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন রলি শ্রীবাস্তব @Rolionaroll এবং নাঈমুল করিম @Naimonthefield; লিখেছেন রলি শ্রীবাস্তব; সম্পাদনা করেছেন কিরেন গিলবার্ট এবং ক্লেয়ার কোজেন্স। অনুগ্রহ করে থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে ক্রেডিট দিন, যা থম্পসন রয়টার্সের দাতব্য শাখা এবং যা মানবিক, নারী ও এলজিবিটি+ অধিকার, মানবপাচার, সম্পত্তির অধিকার এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করে। ভিজিট করুন: http://news.trust.org)
Our Standards: The Thomson Reuters Trust Principles.